Tuesday 5 October 2010

মা বিহীন দিনগুলো




সময়টা ১৯৯৩ সাল এর দিকে। ক্লাস থ্রির বার্ষিক পরিক্ষা শেষ; ফোরে উঠলাম। ক্লাস ও শুরু হয়ে গেছে। ঠিক তখনি স্বিদ্ধান্ত হল যে আমাকে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যেতে হবে, মানে গ্রাম থেকে ঢাকাতে চাচার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে হবে। এই খবর পাওয়ার পরে খুশিতে লাফাচ্ছি। ঢাকা যাব পড়তে; ভাবতে ভালই লাগছিল। মাথায় আর কোন ভাবনার উদয় হচ্ছিল না। যথা সময়ে চাচার সাথে ঢাকা রওনা দিলাম। লঞ্চে করে ঢাকা যাচ্ছি অনেক ভাল লাগছে। রাতে ঘুমালাম। ভোরে যখন ঘুম ভাঙল তখন ইতোমধ্যে ঢাকা চলে আসছি।

তখনি মনের মধ্যে একটা হাহাকার বোধ করলাম। কারন আজ ঘুম থেকে উঠে আমার মায়ের মুখ দেখা হয়নি। মিরপুরে চাচার বাসায় আসলাম। শুরু হল আমার শহুরে জীবন। বাসার পাশে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হল। ক্লাস এ যেতে শুরু করলাম। কিন্তু জীবনে ছন্দ খুজে পাচ্ছিলাম না। মায়ের কথা খুব মনে পরত। আর সারক্ষন কান্না পেত। আমার এক একটা দিন মনে হতে লাগল এক একটা বছরের মত। ক্লাসে যেয়ে পিছনে বসে থাকতাম। মন বসত না। মনে হত ক্লাস আর শেষ হয় না। বিকালে স্কুল থেকে এসে কোন কাজ পেতাম না। বারান্দায় যেয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, রাস্তার মানুষ দেখতাম। বিকেলগুলো যে এতটা বিষন্ন হতে পারে আমার জানা ছিল না। মাকে ভুলতে পারছিনা এক মুহুর্তের জন্য। সব সময় গলার কাছটাতে কান্না উঠে এসে দলা পাকিয়ে থাকত। সন্ধ্যা ফুরায়; রাত আসে। রাতের খাবারের পরে ঘুমাতে যায় সবাই, আমিও যাই। সবাই ঘুমিয়ে পরে। আর আমার কান্না শুরু হয়। আমার মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নাই। আমি বড় একা। আমি কেমন ঘোরের মধ্যে চলে যাই। সিলিং এর সাথে ফ্যান ঘুরছে। বারান্দা থেকে দরজা হয়ে ল্যাম্পপোস্ট এর আলো পরত অর্ধেকটা ফ্যান এ। অশরিরী লাগত ব্যাপারটা আমার কাছে। মনে হত আমার এই কষ্টের জীবনটা ওই চলমান ফ্যানের মতই চলতে থাকবে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পরতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ে যেত আমার মা আমার কাছে নাই। এখন কেউ বলেনা ‘আব্বু উঠো, সকাল হয়ে গেছে’। বুকটা ভেঙে কান্না আসত । কান্না চেপে রাখতে পারতাম না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম পেটে ব্যাথা করতেছে। আজ ও অনেকেই জানেনা আমার সেই কান্নার কারন। প্রত্যেকটা দিন আমার একইভাবে কাটতে লাগলো।

মায়ের কাছে চিঠি লিখতাম, মাসে তিন চারটা। কি লিখব বুজতে পারতাম না। কষ্টের কথাগুলো লিখতে পারতাম না চিঠিতে। ভাবতাম আমার কষ্টের কথা শুনে মা যদি আমার জন্য কান্না করে। মায়ের কান্না ভেজা চোখ আমি কল্পনা করতে পারতাম না। মা যখন আমাকে চিঠি লিখত আমি তার মধ্যে মায়ের স্নেহের গন্ধ খুজে বেড়াতাম।

একবার টাইফয়েড হল। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। একশ পাঁচ একশ ছয় পর্যন্ত উঠে যায় জ্বর। সারাক্ষন পাশে মাকে খুজে বেড়াই। মায়ের হাতের একটু ছোয়া কপালে পেতে খুব ইচ্ছা করে। মা একটু হাত বুলিয়ে দিলেই আমি ভাল হয়ে যাব। মনে হচ্ছিল আমি আর বাচবো না। আমি মরে গেলে মা অনেক কাদবে ভেবে আমার কান্না পাচ্ছিল। আবার মায়ের উপর অনেক অভিমান হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার মা নাই। এই পৃথিবীতে যার মা নাই আমি তার কষ্টটা অনুভব করতে পারছিলাম।

এক সময় জ্বর ভাল হল। কিন্তু আমার সময় আগের মতই কাটছে। পড়ালেখায় মন নাই। রেজাল্ট ভাল হচ্ছে না। এভাবে দীর্ঘ এক বছর কাটল যেখানে আমার একটা দিন ছিলনা যেদিন আমি কাদিনাই। একদিন আমার সব কান্না শেষ হল। আমাকে আবার বাড়িতে নিয়া আসা হল। কারন যেই পড়াশোনার উন্নতির জন্য আমাকে ঢাকা পাঠান হয়েছিল আমি তা করতে ব্যার্থ হয়েছি।

এর পড়ে দশটি বছর কেটে গেছে। আমি ইন্টার এ পড়ছি। কোন একদিন কি যেন একটা কাজে মায়ের আলমিরা খুলে খোজাখুজি করছিলাম। হঠাৎ কিছু চিঠি পেলাম। পড়ে দেখি এগুলো মায়ের কাছে আমার লেখা সেই চিঠি গুলো। মা আজও যা স্বযত্নে রেখে দিয়েছেন। মা আমি চাইনা আমার কারনে তোমার চোখে জ্বল আসুক। তোমায় অনেক ভালবাসি মা।

... ... ... ... ... ... ... ... ... ...

লেখাটা 'মমতাময়ী'তে প্রকাশিত।

Thursday 18 February 2010

রাত জাগা ল্যাম্পপোষ্ট








ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। শুরু হচ্ছে আরেকটি দীর্ঘ ক্লান্তিকর রাতের। যার আদ্যপান্ত শুধু একাকিও্ব আর বিষন্নতা। একফোটা ঘুমের জন্য জেগে থাকতে থাকতে রাত পার হয়ে যায়, ঘুমানো আর আমার হয়না। হয়তবা এটা আমারই দোষ। হয়তবা আমিই চাইনা ঘুমাতে। হয়তবা তাকে নিয়ে ভেবে আমি যে সুখ টুকু পাই, আমি চাইনা ঘুমিয়ে তা নষ্ট করতে। জীবনের সমীকরনগুলো আস্তে আস্তে জটিল হয়ে যাচ্ছে। জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, ক্রমশ হতেই থাকবে। এর শৃঙ্খল থেকে আমার মুক্তি নেই। জেগে থাকা আর শেষ হয়না আমার। জেগে থাকি দূরের ওই ল্যাম্পপোষ্টের মত।